আধুনিকতার যুগে যখন নতুন নতুন প্রযুক্তি উন্নত থেকে উন্নততর অভিমুখে যাত্রা করছে ঠিক তখনই মানুষ ঐতিহ্য বাঁচাতে পুরনো প্রথার উপর ভরসা রাখছেন ।
কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা নিঃশব্দে নিজের সবটুকু দিয়ে পুরোনো ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখেন। ইতিহাস তার খোঁজ রাখে না। অথচ নীরবে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করে যান সমাজ ও সংসারের জন্য। এমনই একজন নীরব যোদ্ধা নদিয়ার হাঁসখালী থানার বেতনা লোকনাথপুরের বাসিন্দা প্রকাশ প্রামানিক। বয়স 45 বছর, স্ত্রী শম্পা প্রামানিক ও একমাত্র ছেলে শান্তুনু প্রামানিককে নিয়ে ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে বসবাস করেন তিনি। তার হাত ধরেই বহু প্রাচীন বিনিময় প্রথাকে বাঁচিয়ে রেখেছে ওই এলাকার মানুষ।
প্রকাশ বাবুর বাবা ছিলেন কানাই প্রামানিক, গ্রামের একমাত্র নাপিত। তিনি পুরো গ্রামের পরিবারকে বিনিময়ের মাধ্যমে চুল, দাঁড়ি ও যাবতীয় খৌর কর্মের কাজ করতেন বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে। তিনি মারা যাবার পর ছেলে প্রকাশ বাবু চোয়াল শক্ত করে সংসারের হাল ধরে রেখেছেন বাবার পথ অনুসরণ করে। বাবার আদি ব্যাবসাকে সম্মান জানিয়ে বাজারে কোনো সেলুন না খুলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুল দাড়ি কেটে দেন বিনিময়ের চুক্তিতে। বিনিময়ে পান ফসল উঠলে ধান, চাল, সরিষা। এই ভাবেই সংসার চালান তিনি। নিজের ছেলেকে নিদারুণ কষ্টের মধ্য দিয়ে পড়াশুনা করাচ্ছেন। শান্তুনু বগুলা শ্রীকৃষ্ণ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়াশুনায় মেধাবী , মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বিভাগে পাস। অভাব নিত্য সঙ্গী।
গ্রামের আদেশ কুমার বিশ্বাস, বীরেন প্রামানিক এনারা জানান–”প্রকাশ বাবুর কোনো চাহিদা নেই। ফসল উঠলেই আমরা ন্যায্য মতো ফসল দিই।”
“মাঝে মাঝে মনে হয় আর হয়ত বেশিদিন এভাবে চলতে পারবো না। বাড়ি থেকে বেরোলেই নগদ টাকা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু এই পথে জীবিকা নির্ধারণ করার আলাদা একটা তৃপ্তি কাজ করে। বিনিময় প্রথার মধ্যে কাজ করে মানুষের সঙ্গে মানুষের এক আত্মিক যোগাযোগ যা টাকা পয়সা বা নগদ অর্থে সম্ভব নয়। টাকা দেবার পর কেউ মনে রাখে না। কিন্তু বিনিময়ের মধ্যে থাকে সুগভীর আন্তরিকতা।” –––বলছিলেন প্রকাশ বাবু।
মানুষের প্রয়োজন যখন লোভের সীমাকে অতিক্রম করে না, তখন চাহিদা হয় খুব সামান্যই। সেই চাহিদার যোগান দেন এলাকাবাসী। আর এভাবেই হাঁসখালীর বুকে বিনিময় প্রথা কে বাঁচিয়ে রেখেছেন বেতনা লোকনাথ পুরের বাসিন্দারা।